সামাজিকীকরণ ও উন্নয়ন

অষ্টম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - NCTB BOOK

সামাজিকীকরণ মানুষের জীবনব্যাপী একটি চলমান প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজ জীবনের কাঙ্ক্ষিত আচরণ উপযোগী হয়ে গড়ে উঠে। এ প্রক্রিয়ায় সমাজের নিয়ম-নীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আদর্শ ইত্যাদি আয়ত্ত করে ব্যক্তি যেমন নিজের উন্নয়ন ঘটায় তেমনি সমাজ উন্নয়নেও অংশগ্রহণ করে। তোমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে সামাজিকীকরণ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করেছ। এ অধ্যায়ে শিশুর সামাজিকীকরণে কতিপয় উপাদানের প্রভাব, বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং সামাজিকীকরণে বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে অবহিত হবে।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-
• সামাজিকীকরণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উপাদানের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব ;
• বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া তুলনা করতে পারব ; 

• সামাজিকীকরণে গণমাধ্যম ও তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করা ও এর ইতিবাচক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হব ; 

• সামাজিকীকরণে বিশ্বায়নের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব এবং এ সম্পর্কে বাস্তব তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রণয়ন ও উপস্থাপন করতে পারব ;

• মানবিক ও সামাজিক গুণাবলি রপ্ত করে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের যোগ্যতা অর্জন করব এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণে উদ্বুদ্ধ হব ।

Content added By

সামাজিকীকরণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রভাব

ব্যক্তির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সামাজিকীকরণ প্রয়োজন। জন্মের পর থেকেই মানব শিশু সমাজের নিয়ম- কানুন ও রীতিনীতি শিখতে থাকে। একেই বলা যায় তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। এই অধ্যায়ে আমরা সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্পর্কে জানব।

পরিবার : সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান বাহন পরিবার। পরিবারে বসবাস করতে গিয়ে শিশু পরিবারের সদস্যদের প্রতি আবেগ, অনুভূতি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মচর্চা, শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে পারিবারিক সংস্কৃতির প্রতিফলন সরাসরি ব্যক্তির উপর পড়ে। এজন্যেই বলা হয় সামাজিকীকরণের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বাহন হচ্ছে পরিবার ।

স্থানীয় সমাজ : মা-বাবা বা পরিবারের পর স্থানীয় সমাজই শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চারপাশের মানুষের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি দেখতে দেখতে শিশু বেড়ে উঠে। এভাবে সে সহজেই সমাজের রীতিনীতি শিখে যায়। স্থানীয় মানুষের ভাষা, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধ তার আচরণে প্রভাব ফেলে।

স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন উপাদান : স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সমিতি, সাংস্কৃতিক সংঘ, খেলাধুলার ক্লাব, সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র, বিজ্ঞান ক্লাব প্রভৃতি। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা এসব সংগঠন ব্যক্তির চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি এসব সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে জড়ায়। সংগঠনভুক্ত অন্যদের সঙ্গে মিশে তার বুদ্ধিবৃত্তি, সুকুমার বৃত্তি ও সৌন্দর্যবোধ জেগে উঠে। এই বোধ তাকে সহনশীল হতে শেখায়। এভাবেই ব্যক্তি স্থানীয় সমাজের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ায় এবং তাদের অংশ হয়ে উঠে।

সমবয়সী সঙ্গী : শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সমবয়সী বন্ধু বা সঙ্গীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শৈশবে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলার আকর্ষণ থাকে অপ্রতিরোধ্য। এভাবে খেলার সাথিরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে। কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও চালচলনের ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে প্রভাবিত করে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সহনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরস্পরের সাথে মিলিত হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে একে অপরকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলি অর্জন করতে পারে। এভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব এবং আন্দোলন-সংগ্রামও ব্যক্তির সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করার মাধ্যমে নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে।

কাজ : সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা উল্লেখ করো।  

Content added By

সামাজিকীকরণে বিভিন্ন উপাদানের প্রভাব

কাঙ্ক্ষিত ও সুস্থ জীবনের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমাজের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি, আদর্শ, অভ্যাস আয়ত্ত করতে হয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি এগুলো আয়ত্ত করে। এগুলো আয়ত্ত করার পিছনে অনেক উপাদান কাজ করে। এই উপাদানগুলো হলো: অনুকরণ, অভিভাবন, অঙ্গীভূতকরণ ও ভাষা ।

অনুকরণ : যখন একজন অপরজনের কাজ ও আচার-আচরণ হুবহু নকল করে তখন তাকে অনুকরণ বলে। শিশুরা সবসময়ই বড়দের অনুকরণ করে। অনুকরণের মাধ্যমে শিশু ভাষা, উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি ইত্যাদি আয়ত্ত করে থাকে। বড়রাও অনেক সময় অন্যকে অনুকরণের মাধ্যমে নতুন বা অচেনা পরিবেশের উপযোগী করে নিজেকে খাপ খাওয়ায়।

অভিভাবন : অভিভাবন এক ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাব বা তথ্যাদি অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। শিশুদের মধ্যে যুক্তি বা জ্ঞানের পরিপক্কতা থাকে না, তাই তারা সহজে অভিভাবিত হয়ে যায়। অভিভাবন প্রক্রিয়ার প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন- শিক্ষা, রাজনীতি, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি। অভিভাবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় নিজের ধ্যান-ধারণাকে অপরের মধ্যে প্রবিষ্ঠ করানোর এবং অন্যের আচার-আচরণ ও কাজ কর্মকে নিজের অভিপ্রায় অনুসারে পরিচালিত করার। সাম্প্রতিককালে সমাজব্যবস্থায় প্রচার কার্য ও বিজ্ঞাপনের ব্যাপক উদ্যোগ অভিভাবনের মনস্তাত্ত্বিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

অঙ্গীভূতকরণ : শিশু শৈশবে সচেতনভাবে বা সজ্ঞানে কিছুই করে না। শৈশব অবস্থায় সে সব কিছু এলোমেলোভাবে করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে কোন জিনিস তার প্রয়োজন তা সে বুঝতে পারে এবং এই জিনিসগুলো তার অঙ্গীভূতকরণের বিষয়ে পরিণত হয়। এইভাবে শিশু অঙ্গীভুত করে নেয় বিভিন্ন খেলনা, ছবি ও ছড়ার বই প্রভৃতি যা তার বিনোদনে কাজে লাগে। এছাড়া মা-বাবা ও অন্যদের যারা তার ভালোমন্দের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদেরকেও অঙ্গীভূত করে নেয় । শিশুরা তার পছন্দমতো নিজেকে সাজাতে ভালোবাসে । যেমন নিজেকে স্পাইডারম্যান সাজিয়ে সবাইকে চমকে দিতে পছন্দ করে। এটি শিশুর এক ধরনের বিনোদন। অঙ্গীভূতকরণের এই প্রক্রিয়া ও প্রবণতার পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে এবং সমাজবদ্ধ মানুষ সামাজিক প্ৰকৃতি অর্জন করে ।

ভাষা : মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ভাষা। সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় ভাষার মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। ভাষার মাধ্যমে ব্যক্তি তার মনের ভাব প্রকাশ করে। তাছাড়া একে অন্যকে জানা কিংবা নিজের দেশ ও সমাজ এবং বহির্জগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, শিক্ষা গ্রহণ সবই চলে ভাষার মাধ্যমে । বস্তুত ভাষা শৈশব থেকে ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে।

কাজ : সামাজিকীকরণে ভাষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।

Content added By

বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া

বাংলাদেশের প্রায় ৮৫% লোক গ্রামে বাস করলেও গ্রাম ও শহর নিয়েই বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা । এদেশের অধিকাংশ মানুষের সামাজিকীকরণ হয় গ্রামীণ পরিবেশে। তবে শহরের সমাজ কাঠামো আলাদা হওয়ায় সেখানকার সামাজিকীকরণের ধরন গ্রামের থেকে একটু আলাদা । গ্রাম ও শহরের পরিবার কাঠামোর পার্থক্যের কারণে শিশুর সামাজিকীকরণও ভিন্ন হয়।

গ্রামের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া : গ্রামীণ পরিবেশে শিশু নিজ পরিবারসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের
মাঝে বেড়ে উঠে। এতে পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণের সাথে শিশুর আচরণের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। এর মাধ্যমে শিশু সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ প্রভৃতি গুণাবলি অর্জন করে। গ্রামের মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, জাতিগোষ্ঠী, সমবয়সী দল ও খেলার সাথি, কর্মক্ষেত্র, স্ব স্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ব্যক্তির সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন- উৎসব, পালাগান, লোক নাটক, লোক সংগীত, যাত্রা, পুতুল নাচ, লৌকিক আচার প্রভৃতির মাধ্যমেও গ্রামে সামাজিকীকরণ ঘটে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম । তবে ইদানীং টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদিও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

শহরে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া : শহরের মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবারই সবচেয়ে প্রথম ও প্রধান মাধ্যম। পরিবারই হচ্ছে শিশুর শিক্ষার প্রথম মাধ্যম। পরিবারের পর সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম। শহরের অধিকাংশ মানুষ উন্নয়নমুখী। শহরের মানুষের সামাজিকীকরণে কর্মক্ষেত্র, বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সভা-সমিতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শহরে গণমাধ্যম সামাজিকীকরণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। মানুষ বিশ্বের বহু তথ্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। ফলে শহরের মানুষ সমকালীন সমাজ ও বহির্বিশ্বের নিত্য নতুন তথ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সহজে গ্রহণ করে এবং দ্রুত নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।

সামাজিকীকরণে প্রতিবেশীর ভূমিকা গ্রাম ও শহর উভয় সমাজেই ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। গ্রামীণ সমাজে প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হয় শহরের ক্ষেত্রে ততটা হয় না। গ্রামে শিশুরা যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়, অন্যদিকে শহরের অধিকাংশ শিশু বেড়ে ওঠে একক পরিবারে । যার ফলে কখনো কখনো শহরের শিশুদের আচরণে পারস্পারিক সহযোগিতা মূলক আচরণের অভাব দেখা যায় । তবে শহরের শিশুরা খেলাধুলা কিংবা আনন্দ উৎসবে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে অনেক সময় একে অন্যের আপন হয়ে যায়। শিশু-কিশোররা প্রতিবেশীর গণ্ডিতে থাকলে সহজে সমাজ স্বীকৃত আচরণ শিখে। ভালো কাজের প্রশংসা ও খারাপ কাজের সমালোচনা তাদেরকে সমাজ স্বীকৃত আচরণ করতে উৎসাহিত করে। এভাবে বিদ্যালয়, গণমাধ্যম, স্থানীয় খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ ঘটে থাকে। বর্তমান সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রাম ও শহরে সামাজিকীকরণের ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসছে ।

কাজ : গ্রাম ও শহরের সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা বর্ণনা করো ।

 

Content added By

ব্যক্তির সামাজিকীকরণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা

জনগণের কাছে সংবাদ, মতামত ও বিনোদন পরিবেশন করা হয় যেসব মাধ্যমে তাকেই বলা হয় গণমাধ্যম। যেমন- সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র। আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বলতে বোঝায় সেই প্রযুক্তি যার সাহায্যে তথ্য সংরক্ষণ ও তা ব্যবহার করা যায়। যেমন ইন্টারনেট, ফোন প্রভৃতি। গণমাধ্যম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যক্তির সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজকের দিনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এর গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে।

সংবাদপত্র : সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সংবাদপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সংবাদপত্র জনশিক্ষার একটি প্রধান মাধ্যম। আপন সমাজ ও বিশ্ব সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে তা মানুষের মনের সংকীর্ণতা দূর করে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও বিশ্বজনীনতার বোধ সৃষ্টি করে।

বেতার বা রেডিও : বেতার কেবল সংবাদই পরিবেশন করে না, শিক্ষা ও বিনোদনমূলক নানা অনুষ্ঠানও প্রচার করে। এর ফলে গণসচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের মধ্যে সংস্কৃতিবোধ সৃষ্টি হয় ৷

টেলিভিশন : আজকের দিনে সারা পৃথিবীতেই টেলিভিশন সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় গণমাধ্যম ৷ মানুষের চিন্তাভাবনা ও জীবনযাপনকে এটি নানাভাবে প্রভাবিত করে। টেলিভিশন বিনোদন এবং তথ্য ও শিক্ষামূলক নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে নাগরিকদের আনন্দ ও শিক্ষা দেয়। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের উপর টেলিভিশনের প্রভাব খুব বেশি। এই প্রভাব ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই রকমই হতে পারে। টেলিভিশনে যদি বেশি করে আকর্ষণীয় শিক্ষা ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তবে তা মানুষকে আলোকিত করে তুলতে পারে। আপন দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নবীন প্রজন্মের মানুষকে পরিচিত করে তোলার মাধ্যমে টেলিভিশন তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে পারে। এর ফলে সামাজিকীকরণের কাজটি সহজ হয়। অন্যদিকে টেলিভিশনের সস্তা বিনোদনমূলক বা রুচিহীন অনুষ্ঠান সমাজের বিশেষ করে শিশু-কিশোর মনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তারা অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠে। অতিরিক্ত বা রাত জেগে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়।

চলচ্চিত্র : সুস্থ, রুচিশীল ও শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে মূল্যবোধ, মানবিকতা ও সহমর্মিতার বোধ জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে সামাজিকীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উল্টোদিকে অশ্লীল ও রুচিহীন চলচ্চিত্র সমাজের মানুষের মূল্যবোধ ও রুচির অবনতি ঘটায়। সমাজের উপর যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সামাজিকীকরণে সহায়তা করার পরিবর্তে তা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অপরাধ প্রবণতা ও বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাব : ইন্টারনেট প্রযুক্তি বর্তমানে দেশ বা দেশের বাইরে একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগকে খুবই সহজ করে দিয়েছে। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভাববিনিময়, পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষের সঙ্গে পণ্যবিনিময় সংক্রান্ত আলোচনা, চুক্তি ইত্যাদি এখন ঘরে বসে অল্প সময়েই করা যায়। কিছুদিন আগেও যা ভাবা যেত না। এভাবে ব্যক্তির সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ইলেক্ট্রনিক মেইল : ই-মেইলের সঙ্গে আমরা সবাই আজকাল পরিচিত। ই-মেইল হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক মেইল এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে ও কম খরচে দেশে-বিদেশে চিঠি ও তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। ই-মেইল পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। ব্যক্তির সামাজিকীকরণের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে বর্তমানে ই-মেইলের কোনো বিকল্প নেই।

ইলেক্ট্রনিক কমার্স : ইলেক্ট্রনিক কমার্সকে সংক্ষেপে বলে ই-কমার্স। এ পদ্ধতিতে অনলাইনে ক্রেতা- বিক্রেতার মধ্যে পণ্য লেন-দেন করা যায়।

ফেসবুক ও টুইটার : ফেসবুক ও টুইটারের সাহায্যে খুব সহজে দেশে বা বিদেশে যে কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি এবং মতামত ও ছবি বিনিময় করা যায়। আধুনিক বিশ্বে এটি সামাজিক যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর দিন দিন এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে বিজ্ঞানের অন্য অনেক আবিষ্কারের মতো ইন্টারনেট, ফেসবুক ও টুইটারেরও কিছু মন্দ বা নেতিবাচক দিক আছে। মানুষের হাতে এগুলোর অপব্যবহার ব্যক্তি ও সমাজ দুইয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে । আজকাল প্রায়ই তরুণ সমাজের উপর ইন্টারনেট ও ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা শোনা যায়। এ বিষয়ে আমাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।

কাজ- ২ : ব্যক্তির সামাজিকীকরণে ই-মেইলের প্রভাব উল্লেখ করো।

কাজ- ২ : ব্যক্তির সামাজিকীকরণে ই-মেইলের প্রভাব উল্লেখ করো ।

Content added || updated By

বিশ্বায়ন ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া

আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম পৃথিবীর একদেশ থেকে অন্যদেশের দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। তাই বিভিন্ন দেশের সমাজ ও সংস্কৃতি আমাদের জীবনের উপর প্রভাব ফেলছে। আর এটাই হচ্ছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্ব এখন বিশ্বপল্লিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে মানুষ এখন নিজ সমাজ ও সংস্কৃতির মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। মানুষ এখন বিশ্ব নাগরিক। কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর একদেশ থেকে অন্যদেশে ছুটে বেড়ায় এবং তথ্য সংগ্রহ করে। তাই তাকে বিশ্ব সমাজ সম্পর্কে জানতে হয়। একই কারণে মানুষকে তার নিজ সমাজ ও সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্য সমাজ ও সংস্কৃতির সাথেও খাপ খাইয়ে চলতে হয় । বিশ্বায়ন ও সামাজিকীকরণ তাই পাশাপাশি চলে।

শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অনেক। বিশেষ করে বৈশ্বিক সামাজিকীকরণের ফলে আমরা এখন বিশ্ব সমাজের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি। আমরা বিশ্বের বহু দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে পারস্পরিক ভাব-বিনিময় করছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একে অন্যের সহযোগিতা পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত ইংরেজি ভাষা জানা থাকলে এখন ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বিশ্বের সকলের কাছাকাছি যাওয়া যায়। গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ আজ ঘরে বসেই পৃথিবীর নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে। প্রত্যেকে নিজেকে একজন বিশ্ব নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলে নিজের ও সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে। তাই ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বিশ্বায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। যা মানুষের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে।

কাজ : সামাজিকীকরণে বিশ্বায়নের প্রভাব বর্ণনা করো।

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion